সৃতির আয়নায় অম্লান মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শব্দ সৈনিক সাবেক মাদারীপুর ছাত্রলীগের সভাপতি সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন ভাই এবং কিছু কথাঃ আহসান উল্লাহ সম্পাদক, দৈনিক জনতা।
বিচ্ছেদ সব সময়ই বেদনাদায়ক। আর সে বিচ্ছেদ যদি হয় চির বিদায়ের। কোনো প্রিয় ব্যক্তিত্বের চির বিদায় ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। মনকে করে কাতর ও পীড়িত। আমরা সেই বিচ্ছেদের সময় ভুলে যাই মানুষ মরণশীল। জন্ম ও মৃত্যু মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এটা মানুষের নয় সব প্রাণীর এক অনিবার্য পরিণতি। অমোঘ সত্য। আমার সাংবাদিক জীবনের এককালের সহকর্মী বন্ধু আমির হোসেন সাহেব তার কর্মস্থল ডেইলি সান অফিসে কাজ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৭ সালের ৬ মার্চ।
আমির হোসেন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৬৯ সালে। ১৯৬৬ সালে আইয়ুব-মোনেম আমলে ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয় স্বৈর সরকার। ইত্তেফাক প্রেস কনফিসকেট করা হয়। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়াকে কারারুদ্ধ করা হয়। আমরা ইত্তেফাকের সবাই বেকার হয়ে যাই। আমার মামা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন কিছু দিন বেকার থাকার পর সংবাদ সংস্থা পিপিআইতে ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগদান করেন। পিপিআইতে প্রায় দুই বছর মতো ছিলেন। সেখানে আমির হোসেন রিপোর্টার ছিলেন। আমির হোসেন এক সময় ইত্তেফাকের মাদারীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। আগে থেকেই তাদের দুজনের আলাপ পরিচয় ছিল। পিপিআইতে কাজ করার সময় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমির হোসেন তার কাজের দ্বারা সিরাজুদ্দীন হোসেনের মন জয় করতে সমর্থ হন। ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হলে সিরাজুদ্দীন হোসেন তার পুরনো জায়গায় ফিরে আসেন। তিনি আমির হোসেনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে গেলে আমি ডেইলি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় চাকরি পেয়ে যাই। দুই বছর সেখানেই ছিলাম। দৈনিক ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হলে আমিও পুরনো জায়গায় ফিরে আসি। ইত্তেফাকে ১৯৬৯ সালে আমির হোসেন সাহেবের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তবে ঘনিষ্ঠতা তেমন হয়নি। আমি ডেস্কের লোক ছিলাম— সাব এডিটর। আর আমির হোসেন সাহেব ছিলেন রিপোর্টার। ওই সময় ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার ছিলেন খোন্দকার আবু তালেব। পরবর্তী সময়ে চিফ রিপোর্টার হন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। আমির হোসেন তার কাজের দ্বারা এবং আচার-আচরণের দ্বারা সবারই মন জয় করেছিলেন। বার্তা বিভাগের সর্বময় কর্তা এবং তৎকালের শ্রেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন তাকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। আমির হোসেন রিপোর্টার হিসেবে মেধাবী ও দক্ষ ছিলেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি মাদারীপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। কাজেই তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা বেশ প্রখর এবং স্বচ্ছ ছিল। পলিটিক্যাল রিপোর্টগুলো তিনি ভালো লিখতেন। আর বাংলা এবং ইংরেজি দুটো ভাষাই ভালো লিখতেন। বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের একটি উক্তি আমার মনে পড়েছে। কথাটা আমার মনে আছে। কোনো এক প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমির তুই তো আমার থেকে ভালো ইংরেজি লিখিস।
আমির হোসেন সাহেবের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা স্বচ্ছ ছিল। এর পেছনে তিনি স্কুল জীবনেই রাজনৈতিক দীক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি যখন মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া হাইস্কুলের ছাত্র, তখন তাদের হেডমাস্টার ছিলেন হামিদ আকন্দ। হামিদ আকন্দ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং তার রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। জনাব আকন্দ তার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি সম্পর্কে কথাবার্তা এবং পাকিস্তানীদের শোষণ-নিপীড়ন-বৈষম্য এবং প্রাসাদ চক্রান্তের বিষয়ে ছাত্রদের মধ্যে একটি ধারণা সৃষ্টি করেন। প্রকৃতপক্ষে স্কুল জীবন থেকে আমির হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠেন। এরই ফলশ্রুতিতে আমির হোসেন ১৯৬২ সালে মাদারীপুরের নাজিমুদ্দীন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অগ্নিঝরা আন্দোলনের দিনগুলোতে আমির হোসেন ইত্তেফাকে প্রচুর রাজনৈতিক রিপোর্ট লিখেছেন। ওই সময়ে তিনি মাঝে-মধ্যে মাদারীপুরে যেতেন। প্রায়ই মাদারীপুর যাওয়ায় ইত্তেফাকের রিপোর্টিং সেকশনের কাজে কিছু ব্যাঘাত সৃষ্টি হতো। এ জন্য চিফ রিপোর্টার তাহের উদ্দিন ঠাকুর অভিযোগ করতেন। ঠাকুর সাহেব অবশ্য আমির হোসেনের মেধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। একদিন ঠাকুর সাহেব বার্তা সম্পাদককে বলতে শুনলাম, আমির আরও সিরিয়াস হলে He could excel all the reporters of Dhaka. আমির হোসেন সাহেব ওই সময়টাতে ইত্তেফাকে চাকরি করেও মাদারীপুর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি মাদারীপুরের রাজনীতিতে একজন গরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতেন। ’৭৩-এর নির্বাচনে মাদারীপুর থেকে তিনিই আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন বলে সবাই মনে করতেন। আমির হোসেন মাদারীপুরের অধিবাসী আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা আবদুর রাজ্জাকের স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি ছিলেন আমির হোসেন সাহেবের বড় ভাইয়ের মতো। ওই সময়ে শিবচর নির্বাচনী এলাকায় আমির হোসেনের থেকে জনপ্রিয় নেতা আর কেউ ছিলেন না। তার সততা, অমায়িক ব্যবহার, মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা মাদারীপুরের এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। স্কুল জীবন থেকে ভালো ছাত্র এবং ভালো মানুষ হিসেবে এলাকার নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মন তিনি জয় করেছিলেন। সবাই জানত ওই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ থেকে আমির হোসেনকে নমিনেশন দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে নেপেটিজম বা স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য পেল। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলো ইলিয়াস আহমদ চৌধুরীকে। তিনি শেখ ফজলুল হক মণির ভগ্নিপতি এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নিজামাই। ঘটনাটি আমির হোসেনকে একটি বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। তার রাজনৈতিক জীবনের আশা ভঙ্গ হয়। এই না পাওয়ার বেদনা তাকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছিল। ঘটনাটি তার রাজনৈতিক জীবনে ভবিষ্যতে বৃহত্তর পরিসরে দেশ, জাতি ও জনগণের সেবা করার উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। এ ঘটনার পরও দলের প্রতি তার আনুগত্যের কোনো ঘাটতি পড়েনি। তিনি আজীবন আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত ছিলেন। ’৭৩-এর নির্বাচনে মনোনয়ন পেলে তিনি হয়তো আর সাংবাদিকতা জীবনে ফেরে আসতেন না। তার মতো সৎ ৎসিদয়বান মেধাবী একজন ভালো মানুষের সেবা থেকে দেশ ও জনগণ বঞ্চিত হয়। ’৭৩-এ মনোনয়ন না পাওয়ার বঞ্চনা তার একার ছিল না। এ ঘটনা তার এলাকার আপামর মানুষের জীবনেও সে বঞ্চনার ছায়াপাত করে। ’৭৫-এর জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তাতে আমির হোসেন সাহেবও বিপদের মধ্যে পড়েন। তার এলাকার প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে মামলা দেয় এবং তার ওপর হামলার চেষ্টা হয়। ওই সময় তিনি ভারতে চলে যান। পরবর্তী সময়ে ভারত থেকে ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকতাকেই প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি সরে আসেন।
মোহাম্মদ আলী জিন্নার ১৯৪৭ সালের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৪ আগস্ট যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয় সে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি সুবিধাবাদী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের কুশাসন ও বৈষম্যের কালো থাবা জেঁকে বসে। পূর্ব পাকিস্তান সর্বক্ষেত্রে বঞ্চনা, শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই অপশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধারাবাহিক প্রতিবাদ এবং ধাপে ধাপে আন্দোলন ও প্রতিবাদমুখর করে তোলে পূর্ব পাকিস্তানিদের। এ ক্ষেত্রে দৈনিক ইত্তেফাকের একটি বিশাল ভূমিকা ছিল। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখনী শেখ মুজিবের আন্দোলনের সঙ্গে সমানতালে বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করে প্রতিবাদমুখর হতে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়ে ইত্তেফাকের সংগ্রামী ভূমিকার নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
’৭১-এর শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ’৭০-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দেওয়া, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্র বাঙালিদের মনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ৭ মার্চে রমনা রেসকোর্সের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ ঘোষণা বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব-স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইউনেস্কো একে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের একটি বিশাল অর্জন।
১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণের আগের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা উল্লেখ করব। ঘটনাটা এখন হয়তো কেউই জানেন না বা দু-একজন বিষয়টা জানলেও এটা তাদের মন থেকে হারিয়ে গেছে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিতে যাচ্ছেন, এটা সবাই জানত। পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখালেখি হচ্ছিল। চরমপন্থি ছাত্রনেতারা কেউ কেউ ওই দিন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। পাকিস্তান রেডিও এই ভাষণ প্রচার করবে না— এরকম একটা সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল। ৭ মার্চের তিন/চার দিন আগে গভীর রাতে ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন আমির হোসেনকে বললেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে প্রচার হওয়া উচিত এবং দাবিটা এখনই জানানো দরকার। দেখতো নেতাদের কাউকে টেলিফোনে পাস নাকি। পেলে এখনই একটা বিবৃতি নিয়ে দে। আজকেই এটা ইত্তেফাকে যাবে।
আমির হোসেন সাহেব টেলিফোনে রাজ্জাক, তোফায়েল, তাজউদ্দীন এদের যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওই গভীর রাতে কাউকে পাওয়া গেল না।
সিরাজ সাহেব আমির হোসেনকে বললেন, ‘তুই একটা বিবৃতি এখনই লিখে ফেল। আমির হোসেন তার চেয়ারে বসে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচারের দাবি সংবলিত নিউজটা লিখে ফেললেন। আমির হোসেন তার ঘনিষ্ঠজন যুবনেতা তোফায়েল আহমদের নামে তার পূর্বানুমতি ছাড়াই বিবৃতি ছাপার কথা বললে বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন রাজি হয়ে যান। পরদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে সম্প্রচার দাবি সংবলিত তোফায়েল আহমদের বিবৃতি ছাপা হয়ে যায়।
পুরো কাহিনীটা আমির হোসেনের মুখ থেকে শোনা যাক। “২ মার্চের কথা। রাতের মতো কাজ শেষ করে বাসায় ফিরার আগে সিরাজ ভাইর কাছে গিয়ে বললাম, চলে যাচ্ছি, সব কাজ শেষ।
সিরাজ ভাই একটা নিউজের কপি দেখছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, সাংবাদিকদের কাজ আবার শেষ হয় কী করে? লেখা শেষ হয়ে থাকলে বসে বসে পত্রিকা পড়। ঘরে ফেরার তাড়া কিসের?
আমি বললাম, তাড়া নেই কিছুই। আজকের মতো যা লেখার ছিল শেষ করেছি। তাই যেতে চাইছিলাম।
সিরাজ ভাই চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন, চা খা ক্লান্তি ও ঘুম দুটোই পালাবে।
চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।
হাতের কপিটা শেষ করে সিরাজ ভাই বললেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সে যে ভাষণ দেবেন সেটা রেডিওতে প্রচার হলে সারা দেশের মানুষ তার বক্তব্য শুনতে পেত। মিটিংয়ে তো লোক আসবে বড় জোর আট দশ লাখ। পত্রিকা পড়ে ধর তার কয়েক গুণ। কিন্তু বাকিরা? সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ৭ কোটি শুনতে পাবে না, জানতেও পারবে না তিনি কী বললেন। অথচ ভাষণটা রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা হলে মুৎসির্তের মধ্যে তা ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে।
আমি বললাম, কিন্তু সেটা হবে কী করে?
সিরাজ ভাই বললেন, হতে পারে। দেখ না চেষ্টা করে। চা খেয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ধর। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা রেডিওতে প্রচারের দাবি জানিয়ে একটা বিবৃতি ছেপে দেই। দেখা যাক কিছু হয় কিনা। বিবৃতিটা তুই-ই লিখে ফেল। শুধু কনসেন্টটা নিয়ে নে।
তখন রাত ১২টা পেরিয়ে গেছে। চা খেতে খেতেই টেলিফোন করা শুরু করলাম। তাজউদ্দীন সাহেব থেকে শুরু করে যাকেই ডায়াল করি, হয় ঘুমে না হয় বাইরে। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কোনো নেতাকেই পেলাম না। বললাম, কাউকেই পাচ্ছি না, কালকে চেষ্টা করে দেখব!
সিরাজ ভাই বললেন, সময় চলে যাচ্ছে। দেরি করা ঠিক হবে না। কী করা যায় বলত?
আমি বললাম, বিবৃতিটা তোফায়েল আহমেদের নামে হলে যদি চলে, ছেপে দেই। কালকে তাকে সব খুলে বললেই হবে।
সিরাজ ভাই রাজি হলেন। আমি তখনকার যুবনেতা তোফায়েল আহমেদের নামে একটা বিবৃতি তৈরি করে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি সংবলিত সেই বিবৃতি পরদিন ইত্তেফাকে ছাপা হলো।
সে দিনই বিকালে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা আওয়ামী লীগ অফিসে। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি বিবৃতিটা আপনিই ছেপে দিয়েছেন। সারা দিন বিভিন্ন পত্রিকার লোকজন অনুযোগ করেছে, বিবৃতিটা শুধু ইত্তেফাকে পাঠালেন কেন? আমরা কেন পেলাম না ইত্যাদি। বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তাই আর সব পত্রিকায় পাঠানো সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধু অফিসেই ছিলেন। তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে অফিসে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, আমির, তোর বিরুদ্ধে তোফায়েলের নালিশ আছে। তার অনুমতি ছাড়া তুই নাকি তার নাম জাল করে বিবৃতি ছেপেছিস ইত্তেফাকে।
আমি বললাম, যা করেছি গুড ফেইথে করেছি এবং সিরাজ ভাইর নির্দেশে করেছি। সুতরাং এ নালিশে আমি ঘাবড়াইনি।
বঙ্গবন্ধু বললেন, খুব ভালো করেছিস। এটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। ওরা হয়তো খেয়ালই করেনি। সিরাজ এসব ব্যাপারে খুব সজাগ। এ জন্যই আমি তার ওপর এত ভরসা করি। কেমন আছেরে ‘লাল মিয়া’?কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে তরুণ শেখ মুজিব ও সিরাজুদ্দীন হোসেন সহপাঠী ছিলেন। দুজনেই বেকার হোস্টেলে থাকতেন। সেখানে দুজনের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তা সারা জীবন অক্ষুণ্ন থাকে। দুজনেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য ও অনুসারী ছিলেন। তাদের দুজনের বন্ধুত্বের সুবাদেই বঙ্গবন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘লাল মিয়া’ বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোফায়েলের বিবৃতিটা তোরা ভালোই ছেপেছিস। আজ এ ব্যাপারে তাজউদ্দীনের বিবৃতি যাচ্ছে পত্রিকায়। পরদিন পত্রিকায় তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি ক্রমশ এমনই জোরালো হয়ে ওঠে যে, কর্তৃপক্ষ এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আজ আমির হোসেন সাহেব আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তার স্মৃতি কিছু মানুষের মনে অম্লান হয়ে বিরাজ করছে। জীবদ্দশায় তিনি দেশের ও দশের কল্যাণ কামনা করেছেন, কল্যাণে কাজ করেছেন। তার সহজ-সরল জীবনযাত্রায় মানুষের উপকার করার মানসিকতা ও বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে অকৃত্রিম ইচ্ছা আজকের দিনে বিরল। আমির হোসেন সাহেবের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে রাখার একটা মানসিকতা কাজ করত বলে আমি মনে করি। এ কারণেও তার পরিচিতি এবং মেধা, যোগ্যতা অনেকটা লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে গেছে। তার স্মৃতি, তার সুকৃতি শুকতারার মতো অম্লান হয়ে আমাদের ৎসিদয়ে বিরাজ করছে। তার জীবনে না পাওয়ার বেদনা ছিল, তার যোগ্যতার ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি—এ কথা আমি বিশ্বাস করি। তার মৃত্যুর পর তার কিছু কিছু নিকটজন এটা বিশ্বাস করেন।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জনতা।
No comments:
Post a Comment